পরিকল্পনা কমিশনের পর্যবেক্ষণ
সন্দেহের তালিকায় হাজার প্রকল্প
- আপলোড সময় : ০৫-১০-২০২৪ ০৮:৫৩:৪০ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৫-১০-২০২৪ ০৮:৫৫:৩৫ পূর্বাহ্ন
সুনামকণ্ঠ ডেস্ক :: ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাছবিচার করেনি। বেশিরভাগ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে গুটিকয়েক মন্ত্রী, আমলার পছন্দমতো। শুধু তাই নয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যিনি তুষ্ট করতে পেরেছেন তারই প্রস্তাবিত প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রকল্প নেওয়ার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষার তোয়াক্কা করা হয়নি। মন্ত্রী-এমপিদের প্রস্তাবিত এ ধরনের হাজারের অধিক প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায়। এমন তথ্য উঠে এসেছে খোদ পরিকল্পনা কমিশনের পর্যবেক্ষণে। এসব প্রকল্প বিষয়ে কমিশন আগামী যেকোনো একনেক সভায় তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরবে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিকল্পনা কমিশনের এক সদস্য গণমাধ্যমকে বলেছেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) তৈরির অনেক আগে থেকে তদবির শুরু হতো। অথচ প্রকল্প নেওয়ার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য কয়েকটি ধাপ রয়েছে, সে বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে কয়েকটি ধাপ পেরোনোর সময় যেন প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের উপযোগী করে তোলা হয় সেটির জন্যও বিভিন্ন তদবির হতো। আর এসব তদবির আসত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রভাবশালী মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের কাছ থেকে। অর্থাৎ রাজনৈতিক বিবেচনাকে বেশি আমলে নেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনেক আগে থেকে তদবিরের ধূম পড়ে যেত। একদিকে বিভিন্ন প্রভাবশালীর টেলিফোন, অন্যদিকে বিভিন্ন সংসদ সদস্যের সরাসরি দেখা-সাক্ষাৎ থেকে শুরু করে আধাসরকারি পত্র (ডিও লেটার) পাঠানো। তবে সংসদ সদস্যরা মন্ত্রীর মাধ্যমে এ ডিও লেটার পাঠাতেন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব প্রকল্পে বিশেষ নজর দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনের এক সদস্য। তিনি জানান, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রকল্পের বাছবিচার নিয়ে বিশ্লেষণ করা হবে। কারণ যেসব প্রকল্প রয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগ রাজনৈতিক বিবেচনায় এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এমন অনেক প্রকল্প রয়েছে যেখানে সন্দেহের তীর ছোড়া হচ্ছে। ইতিপূর্বে অনেক প্রকল্পের কাজের মেয়াদ বাড়িয়ে প্রকল্প দীর্ঘসূত্রতা করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন অজুহাতে দফায় দফায় প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে লুটপাটের ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। এদিকে চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বৈদেশিক অর্থায়নের মাধ্যমে নতুন প্রকল্প রয়েছে ২৫০টি। তবে এসব প্রকল্প এখনও অনুমোদন হয়নি। আর সরকারি অর্থায়নে অনুমোদনের জন্য অপেক্ষমাণ ৯২৪টি প্রকল্প। এসব প্রকল্পের জন্য প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এখনও অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে ১ হাজার ১৭৪টি প্রকল্প। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপিতে যেসব প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে এখনও অনুমোদনের জন্য অপেক্ষমাণ প্রকল্প ৮২৯টি। এ ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল এক র্কমকর্তা জানান, চলমান প্রকল্প নিয়ে ইতিমধ্যে যাচাই-বাছাই শুরু হয়ে গেছে। নতুন করে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প নির্ধারণ করা হবে, যা আগামী সংশোধিত এডিপিতে প্রতিফলন ঘটবে। সাবেক অর্থ সচিব মুসলিম চৌধুরী বলেন, মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই প্রকল্প নেওয়ার বিষয়টি আওয়ামী লীগ সরকারের চিন্তায় ছিল। এ কারণে অনেক প্রকল্পের জন্য যে সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয় তা সে সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারে না। কোনো কোনো প্রকল্পের মেয়াদ যেন শেষই হতে চায় না। তিন বছরের প্রকল্প যদি ১৫ বছরে গড়ায় তা হলে সেই প্রকল্প নিয়ে তো সন্দেহ দেখা দেয়। এদিকে বেশ কিছু আমলা প্রকল্পের পরিচালক হওয়ার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী হতেন। কারণ প্রকল্পের শুরুতে গাড়ি কেনার প্রবণতা দেখা দেয়। আর কেনাকাটার আড়ালে চলে অবাধ দুর্নীতি। এ মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) তথ্য অনুসারে, ১ হাজার ১৩৮টি প্রকল্পের বয়স পাঁচ বছরের বেশি। আর ৬ থেকে ১০ বছর ধরে চলা প্রকল্পের সংখ্যা ৩৫৭টি। চলতি অর্থবছরে সময় বাড়ানো হয় ৫১৮টি প্রকল্পের। গত অর্থবছরে বাড়ানো হয়েছিল ৪২৯টির। অর্থাৎ প্রকল্পের সময় বাড়ানোর প্রবণতা থেমে নেই। এদিকে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পরিকল্পনা কমিশন আগের সরকারের গৃহীত প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে দেখতে পায় অনেক প্রকল্পই নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় লুটপাটের লক্ষ্যে। এসব প্রকল্পে স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত দশগুণ বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রকল্পগুলোতে অকারণ খরচ বাড়িয়ে লুটপাটের সুযোগও রাখা হয়েছিল। এ রকম ১০টি প্রকল্প চিহ্নিত করেছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পগুলোর ব্যয় সব মিলিয়ে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অপচয়ের এসব উন্নয়ন প্রকল্পই এখন অন্তর্বর্তী সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব প্রকল্প থেকে বড় অঙ্কের বরাদ্দ কাটছাঁট অথবা স্থগিত করা হতে পারে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন (আইএমইডি) সূত্রে জানা গেছে, চিহ্নিত ১০ প্রকল্পের একটি হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট-১। প্রকল্পটির মাধ্যমে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ১৫১ কিলোমিটারের মাত্র ২৮ কিলোমিটার চার লেন করার কথা বলা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে খরচ ধরা হয় প্রায় ৩০৬ কোটি টাকা। এমনকি সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ক্ষমতার মেয়াদের শেষ সময়ে তাকে খুশি করতে ৫ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলে উড়াল সড়ক নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পটি নিয়ে বরাবরই পরিকল্পনা কমিশন, পরিবেশবিদ ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট সবার আপত্তি ছিল। তারপরও প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে আসার দুই সপ্তাহের মধ্যেই তাড়াহুড়ো করে অনুমোদন দেওয়া হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চাঁদপুরের মতলববাসীর জন্য ৪ হাজার ১৭৪ কোটি টাকার প্রকল্প বাগিয়ে নেন তৎকালীন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। পুরো পরিকল্পনা কমিশন সেখানে প্রকল্প নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিল। তবুও নিজের ক্ষমতাবলে প্রকল্প বাগিয়ে নেন প্রতিমন্ত্রী। গত নির্বাচনের আগের একনেকে অর্থায়ন ছাড়াই ৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকার তিন প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। এ প্রকল্পগুলোও তেমন জরুরি ছিল না বলে মনে করা হচ্ছে। এসব প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি প্রকল্পগুলো বাগিয়ে নিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কোনো না কোনোভাবে সন্তুষ্ট করেন। যাচাই-বাছাই করছে পরিকল্পনা কমিশন : এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব (আইএমইডি) আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, পরিকল্পনা কমিশন এসব প্রকল্প নিয়ে যাচাই-বাছাই করছে। যেসব জনবান্ধব প্রকল্প সেগুলো চালু থাকবে। চলমান সব প্রকল্পই চালু রয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো প্রকল্পই বন্ধ করা হয়নি। কিন্তু পরে হয়তোবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যেসব প্রকল্প জনবান্ধব নয় সেগুলোর বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত আসবে। এসব প্রকল্পের অর্থায়ন সংকট হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদেশি অর্থায়নে যেসব প্রকল্প জড়িত সেসব প্রকল্পে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দাতা সংস্থা বিশ^ব্যাংকসহ অন্য সংস্থা বাজেটে সাহায্য করবে। বিদেশির অর্থায়নে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ যেসব প্রকল্পের কাজ ৭০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে সেগুলো বাজেট সংকট হবে না। বাকি প্রকল্পগুলো বিদেশি অর্থ প্রাপ্তির ওপর নির্ভর করবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্পগুলোর যাচাই-বাছাইয়ে কাজ চলছে উল্লেখ করে আইএমইডি সচিব বলেন, এসব বিষয় নিয়ে সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে এসব প্রকল্প বাদ দেওয়ার কথা জানান পরিকল্পনা কমিশনের উপদেষ্টা। -সময়ের আলো
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ